সুস্থ জীবন যাপনে খাদ্যের ভূমিকা ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়া
খাদ্য কি এবং খাদ্যের উপাদান সমূহ কি কি, আমরা সেটি এর মাঝে জেনে গেছি। প্রয়োজন থেকে কম খেলে যেরকম আমাদের স্বাস্থ্যহানি হয়, ঠিক সেরকম প্রয়োজন থেকে বেশি খেলেও স্বাস্থ্য হানি হয়। বেশি খেলে স্থলকার হয়ে যাওয়া উন্নত বিশ্বের মানুষের একটি বড় সমস্যা। তাই আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য সব সময় খাবার খাওয়া প্রয়োজন।
পোস্ট সূচিপত্র: সুস্থ জীবন যাপনে খাদ্যের ভূমিকা ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়া
- ভূমিকা
- সুষম খাদ্য কাকে বলে এবং কি কি
- উন্নত জীবন যাপনের জন্য খাদ্য উপাদান বাছাই প্রক্রিয়া
- ফাস্টফুড বা জাঙ্ক ফুড খাবার এর উপকারিতা ও অপকারিতা
- খাদ্য সংরক্ষণের করার প্রয়োজনীয়তা
- খাদ্য দ্রব্য সংরক্ষণে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার ও এর শারীরিক প্রতিক্রিয়া
- উপসংহার
ভূমিকা
আমাদের সুস্থ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সুষম খাবারের ভূমিকা অপরিসীম। এবং বিভিন্ন
প্রক্রিয়া এই সুষম খাবার কে ভাগ করা হয়। সুষম খাদ্য তালিকা তৈরীর সময় মানুষের
বয়স, লিঙ্গভেদ, কিরকম কাজ করে অর্থাৎ অধিক পরিশ্রমই হলে, মাঝারি পরিশ্রমে, নাকি
স্বল্প পরিশ্রমে ইত্যাদি বিবেচনা করা দরকার। শিশু ও বৃদ্ধদের সহজপাচ্য এবং
চর্বি বর্জিত খাদ্যের প্রাধান্য থাকতে হবে। বারণ তো শিশুদের ক্ষেত্রে প্রোটিন
জাতীয় খাদ্য এবং হাড় ও দাঁতের বৃদ্ধির জন্য ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস সমৃদ্ধ খাদ্য
থাকতে হবে। গর্ভবতী নারীদের খাদ্য তালিকা রক্ত উৎপাদনের জন্য এবং ধনুস্থ শিশুর
বৃদ্ধির জন্য বাড়তি প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও আয়োডিন থাকা খুবই প্রয়োজন। কোন
নির্দিষ্ট সুষম খাদ্য প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না খাদ্য তৈরি করে নিতে হয়।
আরো পড়ুন: সুস্থ দেহ পেতে খাদ্য ও পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা
সুষম খাদ্য কাকে বলে এবং কি কি
যে কোন সুষম খাদ্য তালিকায় শর্করা, শাকসবজি, ফলমূল, আমিষ এবং স্নেহ বা চর্বি
জাতীয় খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। একজন কিশোর বা কিশোরী, প্রাপ্তবয়স্ক
একজন পুরুষ বা নারীর সুষম খাদ্য তালিকা লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে তালিকায় শর্করা
পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। শর্করাকে নিচে রেখে পরিমাণ বিবেচনা করে পর্যবেক্ষণ শাকসবজি,
ফলমূল, আমিষ, স্নেহ ও চর্বি জাতীয় খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন।
উন্নত জীবন যাপনের জন্য খাদ্য উপাদান বাছাই প্রক্রিয়া
সব মানুষের খাদ্যভাস একরকম নয়। প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক কারণে খাদ্যদ্রব্যের
প্রাপ্যতাও সব দেশে একরকম নয়। শীত ও গ্রীষ্মের প্রকোপ অনুসারে খাদ্যের প্রয়োজন
এবং পার্থক্য রয়েছে। সকল পরিবেশে মানিয়ে চলায় হচ্ছে জীবনের লক্ষ্য। এজন্য
দেহের গঠন ও বৃদ্ধিতে এবং শরীর ভিত্তির প্রক্রিয়া গুলো সম্পন্ন করতে মূল খাদ্য
উপাদান গুলোর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে মূল উপাদান গুলো পরিমাণ
এবং ভ্যালু বিচার করে উন্নত জীবন যাপনের জন্য খাদ্য উপাদান বাছাই করতে
হয়। কোন জাতীয় খাদ্য উপাদান কতটুকু খেতে হয় সেই বিষয়ে জানা দরকার
রয়েছে। এই খাদ্য উপাদান ব্যবহার করে কি কি খাদ্য তৈরি করা যায় যেমন-তেল কিংবা
মাখন সরাসরি খাওয়া হয় না, সেটি ব্যবহার করে অন্য খাবার প্রস্তুত করা হয়।
পুষ্টিবিদগণ এই খাবারকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করেছে যথা-
- মাংস, ডিম, মাছ ও ডাল (মটর ছোলা কিংবা বাদাম)।
- পনির ও দই।
- সকল ভোজ্য ফল এবং খাওয়ার উপযোগী সবজি।
- শস্য ও শস্যদানা থেকে তৈরি খাবার যেমন-রুটি, ভাত।
আরো পড়ুন: সুস্থ জীবনের স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনীয়তা
সুষম খাদ্য পেতে হলে প্রতিদিন এই চার শ্রেণীর খাদ্য খেতে হবে। এই চার শ্রেণীর থেকে খাদ্য নির্বাচনের বৈচিত্র থাকা উচিত বলে পুষ্টিবিদগণ মনে করেন। খাবার তৈরি করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে সেখানে যেন আমিষ, শর্করা, স্নেহ পদার্থ, ভিটামিন ও খনিজ লবণ থাকে। সকালের খাবার আমাদের দেশে অত্যন্ত হালকা ধরনের হয়ে থাকে। আজকাল গ্রাম বা শহরে প্রায় সর্বোচ্চ বয়স্কদের সকালের দিকে চা পান করতে দেখা যায়। চায়ের সাথে অন্তত হালকা কিছু খাবার গ্রহণ করা উচিত।
সকালবেলার খাবার হিসেবে রুটি, মাখন বা একটি ডিম, একটি কলা খেতে পারলে দেহের যাবতীয় পুষ্টি উপাদান গুলো সংগ্রহ করা সহজ হবে। গরমের দিনে আখের গুড়ের সাথে চিড়া ভিজিয়ে খেলে শরীর সুস্থ থাকে। আমাদের দেশে দুপুরের খাবারের সাধারণত প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুপুরের খাবারের খাদ্য উপাদান বাছাইয়ের অবশ্যই সুষম খাদ্য তালিকায় সাহায্য নিয়ে সেভাবে খাদ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। গরমের দেশে মাছ প্রোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস। তবে শীতকালে মাছের সাথে মাংস খাবারের মাঝে বৈচিত্র এনে দেবে।। খাওয়ার শেষে দুই অথবা ফল খাদ্য তালিকা থাকলে ভালো হয়।
ফাস্টফুড বা জাঙ্ক ফুড খাবার এর উপকারিতা ও অপকারিতা
ফাস্টফুড বা জাঙ্ক ফুড হচ্ছে এমন এক ধরনের খাবার, যা স্বাস্থ্যগত উপাদানের পরিবর্তে মুখরোচক স্বাদের জন্য তৈরি করা হয়। এগুলো খেতে খুব সুস্বাদু মনে হতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই এই খাবার শরীরের জন্য ভালো নয়। সুস্বাদু করার জন্য এতে প্রায়শই অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে যেগুলো অস্বাস্থ্যকর। ফাস্টফুডে সাধারণত প্রচুর পরিমাণে প্রাণীর চর্বি ও চিনি থাকে। বার্গার, ফ্রাইড চিকেন, পিজ্জা, চিপস, মচমচে ভাজা খাবার, কেক কিংবা বিস্কুটে উচ্চমাত্রায় প্রাণিজ চর্বি থাকে।
আমরা যখন অধিক পরিমাণে চোর জাতীয় খাবার খাই, তখন আমাদের দেহে এগুলো চর্বি কলায় রূপান্তরিত করে এবং অধিক পরিমাণে চিনি আমাদের দাঁত ও ত্বককে নষ্ট করে দিতে পারে। ফাস্টফুড কখনো সুষম খাদ্যের মধ্যে পড়ে না। ফাস্টফুডে আমাদের জন্য দরকার ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের অভাব রয়েছে। ফাস্টফুড খাওয়ার কারণে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের দেহ স্থলকায় হয়ে পড়ে। একের বা কৌটাকাত খাবারের চেয়ে প্রাকৃতিক সজীব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো।
খাদ্য সংরক্ষণের করার প্রয়োজনীয়তা
প্রাকৃতিক কারণে সব ধরনের খাদ্য সময়ের সাথে নষ্ট বা খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। খাদ্য নষ্ট হওয়ার কারণগুলো হচ্ছে-জীবাণু ও ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়া এবং পরিবেশের কারণে সেগুলো দ্রুত বৃদ্ধি, খাদ্যের মধ্যে উৎসেচকের বৃদ্ধি, পরিবেশে আদ্রতা, তাতে অমিল,। এই কারণগুলো এককভাবে খাদ্যকে নষ্ট করে না। কয়েকটি কারণ একত্রে সংঘটিত হয়ে খাদ্য নষ্ট করে। যেমন-পরিবেশে আদ্রতা বৃদ্ধি পেলে জীবাণুর বৃদ্ধি ঘটে এবং খাবারকে নষ্ট করে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে খাদ্য বস্তুর পরিমাণের বৃদ্ধি ঘটে খাদ্যকে নষ্ট করে দেয়।
জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া খাদ্য নষ্ট করে সেখানে এক ধরনের বিষাক্ত উপাদান তৈরি করে। এই বিষাক্ত উপাদানগুলোকে টক্সিন বলে। এই টক্সিন গুলো নানা ধরনের হয় এবং কোন কোন টক্সিনে আক্রান্ত হওয়াকে আমরা ফুট পয়জনিং বলি। টক্সিন স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। ইস্ট জাতীয় ছত্রাক ফলের রস, টমেটোর সস, জেলি, মিষ্টি আচার, শরবত ইত্যাদি খাবার দ্রুত নষ্ট করে ফেলে। এতে খাবারের টক গন্ধ হয় এবং ঘোলাটে হয়ে যায়। যদি পাউরুটি কয়েক দিন খোলা স্থানে রাখা যায়, তাহলে দেখা যায় ওর ওপর ধূসর বর্ণের আবরণ তৈরি হয়েছে। এটি মোলড জাতীয় ছত্রাক দাঁড়া আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হয়ে যায়।
কমলালেবু, টমেটো, পনির আচার প্রগতি টক যাদু খাবার এগুলো দ্বারা সহজে নষ্ট হয়। খাদ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা এক ঋতুর ফল, শস্য, সবজি, মাছ এবং অন্যান্য খাদ্য অন্য রীতিতেও পেতে পারি। বছরের কোন একটি সময়ে ও স্থানে কোন ফসলের উৎপাদন বেশি হলে তা সংরক্ষণের মাধ্যমে অন্য সময় ব্যবহার, বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর বা রুপান্তরিত করতে পারি। কাজেই খাদ্যের গুণগত মানসিক রেখে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য বিভিন্ন উপায়ে আমরা সংরক্ষণ করে আমরা আমাদের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে পারি।
আরো পড়ুন: মানব জীবনের স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব
খাদ্য দ্রব্য সংরক্ষণে রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার ও এর শারীরিক প্রতিক্রিয়া
বর্তমানে দুধ, ফল, মাছ এমন কি মাংসকে পচন থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট ফরমালিন নামক বিষাক্ত একটি রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের জন্য এর ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে কিছু অসাধু ও বিবেক বর্জিত ব্যবসায়ী তারপরও ফরমালিনকে খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহার করছে। এর দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে বদহজম, পাতলা পায়খানা, পেটে না না পিরা,, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, লিভার ও কিডনি নষ্ট হওয়া সহজ ক্যান্সারের মতন মরণব্যাধি হতে পারে। ফরমালিন দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে মেয়েদের গর্ভজাত সন্তান বিকলাঙ্গ পর্যন্ত হতে পারে। বিভিন্ন ফল যেমন-আম, টমেটো, কলা ও পেঁপে যেন দ্রুতপাকে, তার জন্য ripen এবংEthylene নামক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে।
এগুলো ফল পাঠানোর জন্য ব্যবহার করলে সে ফলকে সাত থেকে আট দিন পর বাজারজাত করা উচিত। কিন্তু তা না করে অনেক সময় দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে বাজারজাত করা হয়। এতে রাসায়নিক পদার্থ গুলোর কার্যকারিতা থেকে যায় এবং এই ধরনের ফল খাওয়ার ফলে মানব শরীরের জটিল রোগ সৃষ্টি হতে পারে। ফল পাকানোর জন্য ক্যালসিয়াম কার্বাইড নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থকে ব্যবহার করা হয়। এটি এমন ধরনের যৌগ, যা বাতাসে বা জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে এসেই উৎপন্ন করে অ্যাসিটিলিন গ্যাস, যা পরবর্তীকালে এসিটিলিন ইথানল নামক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের রূপান্তরিত হয়। এটি স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতি করে।
উপসংহার
উপরোক্ত বিষয় হতে আমরা জানলাম সুস্থ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে খাদ্যের ভূমিকা এবং
কিভাবে সে সকল খাদ্য আমরা সংরক্ষণ করতে পারি। এছাড়াও খাদ্য সংরক্ষণের
প্রক্রিয়াসমূহ যে সকল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্য সংরক্ষণ করলে খাদ্যের নানারকম
বিষক্রিয়া উৎপাদন হতে পারে। যা আমাদের দেহের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়াও
বিভিন্ন রকম ফাস্টফুড জাতীয় খাবার যে সকল খাবার আমাদের দেহের চর্বি মেদ তৈরিতে
সাহায্য করে এবং আমাদের শরীরের বিভিন্ন রকম ক্ষতির সাধন করে। এ কারণে আমাদের সুষম
খাবারের তালিকা তৈরি করে দৈনন্দিন জীবনে সুস্থ থাকার জন্য সুষম খাবার খাওয়া
প্রয়োজন।
No comments:
Post a Comment