পরিবেশ সংরক্ষণে পানির ভূমিকা পানি দূষণে প্রতিরোধ
ভূপৃষ্ঠের প্রায়৭৫ ভাগই পানি দ্বারা আবৃত কিন্তু বেশিরভাগ পানি লবণাক্ত তাই সেই পানি সরাসরি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায় না। আমাদের যে শতকরা ১ ভাগ মিঠা পানি সঞ্চিত আছে, তার একটি অংশবিশেষ করে নদ নদী খাল বিল এর পানি নানাভাবে প্রতিনিয়ত দূষিত হয়ে চলছে।
এমনকি ভূগর্ভের যে পানি আমরা খুব বা নলকূপ থেকে পাই এবং খাওয়া থেকে শুরু করে নানা কাজে ব্যবহার করি, সেটিও নানারকম রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে দূষিত হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। যদিও আমাদের পানিসম্পদ প্রচুর, কিন্তু ব্যবহার করা উপযোগী পানির পরিমাণ খুবই অল্প আর সীমিত। তাই পানি ব্যবহার সাশ্রয়ী হবে এবং একই পানি কিভাবে বারবার ব্যবহার করা হয় তা জানতে হবে।
পোস্ট সূচিপত্র:পরিবেশ সংরক্ষণে পানির ভূমিকা পানি দূষণে প্রতিরোধ
- ভূমিকা
- মানসম্মত পানির প্রয়োজনীয়তা
- পানি বিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা
- বাংলাদেশে পানির উৎস দূষণের কারণ
- উদ্ভিদ প্রাণী এবং মানুষের ওপর পানি দূষণের প্রভাব
- পানি দূষণ প্রতিরোধে কৌশল এবং নাগরিকের দায়িত্ব
- পানি প্রবাহের সর্বজনীনতা এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতি
- উপসংহার
ভূমিকা
আমরা জানি যে দিনের বেলা সূর্যের তাপে ভূপৃষ্ঠের সমুদ্রে নদনদী খাল বিলের পানি বাষ্পকিত হয়ে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। এক পর্যায়ে বাষ্প ঘনীভূত হয় প্রথমে মেঘ পরে বৃষ্টির আকার ধারণ করে আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। এই বৃষ্টির পানির বড় একটি অংশ নদ নদী-খাল বিল ও সমুদ্রে গিয়ে পড়ে এবং আবার বাষিত হয় ও আবার বৃষ্টির আকারে ফিরে আসে। পানির এই পুনরাবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হলে কি ধরনের সমস্যা হতো বলতে পারবেন না হয়তো অনেকেই, এই পুনরাবর্তন না হলে বৃষ্টি হতো না যার ফলে পুরো পৃথিবী মরুভূমি হয়ে যেত।
প্রচন্ড খরা হত ফসল উৎপাদন কমে যেত, বৃষ্টি হলো প্রাকৃতিকভাবে পানির পুনরাবর্তন। পরিবেশ সংরক্ষণে পানির ভূমিকা রয়েছে অপরিহার্য। যেহেতু পরিবেশের প্রায় প্রতিটি উপাদান ও প্রক্রিয়া, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে পানির উপর নির্ভর করে, তাই পরিবেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে পানির ভূমিকা অপরিহার্য। পানি না থাকলে গাছপালা জন্মাবে না, ফসল উৎপাদন হবে না। এক কথায় পানি না থাকলে পুরো পৃথিবী এর পরিবেশ সাথে সাথে আমাদের অস্তিত্ব ও ধ্বংস হয়ে যাবে।
আরো পড়ুন: সুস্থ জীবন যাপনে খাদ্যের ভূমিকা ও সংরক্ষণের প্রক্রিয়া
মানসম্মত পানির প্রয়োজনীয়তা
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই আমরা হাত মুখ ধুই আর এই কাজ পানি ছাড়া সম্ভব না। হাত মুখ ধুয়া থেকে শুরু করে গোসল, রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া এবং সর্বোপরি খাওয়ার জন্য পানি অপরিহার্য। এই পানি যদি মানসম্মত না হয় তাহলে প্রত্যেকটা কাজেই সমস্যা হবে। উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায় খাওয়ার পানিতে যদি গন্ধ থাকে বা সেটি যদি লোনা হয় তাহলে কি আমরা সেটা খেতে পারবো অবশ্যই পারবো না। এর বাস্তব প্রমাণ হলো আমাদের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলায় নদী আর ভূগর্ভের পানি লোনা হয় তারা ওই পানি খেতে তো পারছেই না এমনকি দৈনন্দিন জীবনে বেশিরভাগ কাজে ব্যবহার করতে পারছে না।
তারা বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে পরিশোধন করে তারপর সেটি পান করছে এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করছে। আবার খাবার পানি যদি মানসম্মত না বিশেষ করে এতে যদি রোগ জীবাণু থাকে তাহলে সেটা থেকে মারাত্মক স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটতে পারে। সমুদ্রের লোনা পানি কি কৃষি কাজে বা শিল্প কারখানায় ব্যবহার করা যায় না। তার কারণ সমুদ্রের পানিতে প্রচুর লবণ থাকে, যেটা শিল্প কারখানায় ব্যবহার করলে তারা যন্ত্রপাতি ক্ষয়সাধন করে নষ্ট করে ফেলে। একইভাবে আমাদের বেশিরভাগ ফসলও লবণাক্ত পানিতে জন্মাতে পারেনা। অর্থাৎ লবণাক্ত পানি কৃষি কাজের জন্য উপযোগী নয়।
পানি বিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা
ভূপৃষ্ঠে যে পানি পাওয়া যায় তাতে নানা রকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ এমন
কি রোগ সৃষ্টি ও করতে পারে এরূপ জীবন ধ্বংসকারী জীবাণু থাকে। তাই ব্যবহারের আগে
পানি বিশুদ্ধ করে নিতে হয় ভূগর্ভের পানি সাধারণত রোগ জীবাণুমুক্ত, কিন্তু এই
পানিতে আর্সেনিকের মতো নানারকম ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতির কথা আমরা
জানি। পানি কিভাবে বিশুদ্ধকরণ হবে সেটি নির্ভর করে এটি কোন কাজে ব্যবহার করা হবে
তার ওপর। স্বাভাবিকভাবে খাওয়ার জন্য অত্যন্ত বিশুদ্ধ পানি লাগলেই জমিতে শেষ
তাদের জন্য তত বিশুদ্ধ পানির দরকার হয় না। সাধারণত যেসব প্রক্রিয়া পানি বিশুদ্ধ
করা হয়, সেগুলো হলো পরিস্রাবণ, ক্লোরিনেশন, ফুটন্ত, পাতন ইত্যাদি।
পরিস্রাবণ: পরিস্রাবণ হলো তরল আর কঠিন পদার্থের মিশ্রণ থেকে কঠিন পদার্থকে আলাদা করার একটি প্রক্রিয়া। পানিতে অধ্রবণীয় ধুলাবালির কণা থেকে শুরু করে নানা রকম ময়লা আবর্জনার কণা থাকে। এদেরকে পরিস্রাবণ করে পানি থেকে দূর করা হয়। এটি করার জন্য পানিকে বালির স্তরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয়। তখন পানিতে অধ্রমণীয় ময়লার কণাগুলো বালের স্তরে আটকে যায়। কাপড় ব্যবহার করেও পরিস্রাবণ করা যায়।
ক্লোরিনেশন: যদি পানিতে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু থাকে, তবে তা অবশ্যই দূর করতে হবে এবং সেটি করা হয় জীবাণুনাশক ব্যবহার করে। নানা রকম জীবাণু নাশক পানি বিশুদ্ধ করার কাজে ব্যবহার করা হয়। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্লোরিন গ্যাস এছাড়া ব্লিসিং পাউডার এবং আরো কিছু পদার্থ যার মাঝে ক্লোরিন আছে এবং জীবাণু ধ্বংস করতে পারে।
ফুটন্ত: পানির ফুটন্ত কথা আমরা সকলেই জানি এই প্রক্রিয়ায় কি পানিকে জীবাণুমুক্ত করা সম্ভব এ ব্যাপারেও আমরা জানি। পানিকে খুব ভালোভাবে ফুটালে এতে উপস্থিত জীবন ও ধ্বংস হয়ে যায় জীবন মুক্ত করার জন্য কতক্ষণ পানি ফুরাতে হয় এ ব্যাপারে না জানা নয়। ফুটন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে 15 থেকে 20 মিনিট ফুটালে সেই পানি জীবাণুমুক্ত হয়। বাসা বাড়িতে খাওয়ার জন্য এটি একটি সহজ ও সাশ্রয়ী প্রক্রিয়া।
পাতন: যখন খুব বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন হয় তখন পাতন প্রক্রিয়ার পানি
বিশুদ্ধ করা হয়। যেমন ওষুধ তৈরির জন্য, পরীক্ষাগারে রাসায়নিক পরীক্ষা নিরীক্ষার
জন্য পুরোপুরি বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়ায় একটি পাত্রে পানি
নিয়ে তাপ দিয়ে সেটাকে বাষ্প পরিণত করা হয়। বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করা হয়।
এই বিশুদ্ধ করা পানিতে অন্য পদার্থ থাকার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।
বাংলাদেশে পানির উৎস দূষণের কারণ
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব দেশের পানির প্রায় সব উৎস বিশেষ করে ভূপৃষ্ঠের পানি প্রতিনিয়ত নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। এবার আমরা সেই দূষণের কারণগুলো জানব। গোসলের পানি, পায়খানার বর্জ্য পানি কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যবহারের পর সেই পরিত্যাক্ত পানি কোথায় যায়, সেটা কি আমরা সকলে জানি বর্জনীয় বড় একটি অংশ নর্দমার নলের ভেতরে দিয়ে নদ নদীতে ফেলা হয় এবং সেগুলো পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে। এই বর্জ্য পানিতে রোগ জীবাণু থেকে শুরু করে নানারকম রাসায়নিক বস্তু থাকে, যার কারণে পানি দূষিত হয়।
বাসা বাড়ি যেসব কঠিন বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় সেগুলো সাধারণত বাড়ির পাশে রাখা ডাস্টবিন বা অনেক সময় অবিবেচকের মতো খোলা জায়গায় ফেলে দিয়ে। এসব বর্জ্য পদার্থ এক থেকে দুই দিনের মধ্যে পৌঁছতে শুরু করে। বৃষ্টি হলে সেই পচা বড় যেখানে রোগ জীবা নানারকম রাসায়নিক পদার্থ থাকে, বৃষ্টির পানির সাথে মিশে নদ নদী খাল বিল বা লেকের পানিতে দূষিত করে। কি কাজে মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য রাসায়নিক সার জৈব সার আর পোকামাকড় মারার জন্য কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এসব থেকে কি পানি দূষিত হতে পারে না অবশ্যই পারে বৃষ্টি হলে অথবা বন্যার সময় কৃষি জমি প্লাবিত হয়ে কৃষি জমিতে ব্যবহার করার আসানিক সার জৈব সার এবং কীটনাশক বৃষ্টি বা বন্যার পানিতে মিশিয়ে পানিতে দূষিত করে।
এছাড়াও শিল্প কলকারখানা থেকেও পানি দূষিত হয় নদনদীর পানি দূষণের সবচাইতে বড় একটি কারণ হলো শিল্পকলা কারখানার সৃষ্ট বর্জ্য। আমরা সকলেই দেখেছি বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে দুর্গন্ধ এবং এর রং খুসখুচে কালো। এর কারণ হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একসময় গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে অন্যতম রপ্তানি দ্রব্য চামড়া তৈরির কারখানা। নদীতে গিয়ে পড়ার ফলে এর পানি দূষিত হচ্ছে।
উদ্ভিদ প্রাণী এবং মানুষের ওপর পানি দূষণের প্রভাব
নদনদী ডোবা পুকুর খাল বিল এবং ভূগর্ভের উচ্ছের পানি দূষিত হলে সেটি উদ্ভিদ। প্রাণী আর মানুষের ওপর নানারকম ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি কখনো কখনো সেগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। পানি দূষণের এই সকল ক্ষতিকর দিকগুলো আবার তাহলে জেনে যাওয়া হোক। টাইফয়েড, কলেরা, আমাশা, সংক্রামক হেপাটাইটিস বি এসব পানিবাহিত রোগ এ সকল জীবন ধ্বংসকারী রোগ সহ অনেক রোগ পানির মাধ্যমে ছড়ায়, এমনকি সতর্ক না হলে এই রোগ গুলো মহামারী আকার ধারণ করতে পারে।
আরো পড়ুন: সুস্থ জীবনের স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনীয়তা
এসব রোগের জীবাণু নানাভাবে পানিতে প্রবেশ করে, বিশেষ করে মলমূত্র, পচা জিনিস দিয়ে সহজেই এটা ঘটে। সেই পানিতে গোসল করলে সেই পানি পান করলে কিংবা সেই পানি দিয়ে খাবার রান্না করলে বা ধোয়া ধুই করলে অথবা অন্য যেকোনো সেই দূষিত পানি সংস্পর্শে এলে সেটি মানুষ কিংবা অন্যান্য পানির দেহে সংক্রামিত হয়। শুধু তাই নয় কিছু কিছু জৈব পদার্থ আছে যেমন-গোবর, গাছপালার ধ্বংস অবশেষ, খাদ্যের বর্জ্য সেগুলো পচনের সময় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে। আর এর ফলস্বরূপ পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায়। খুব বেশি থাকে তাহলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ একেবারেই শূন্য নেমে আসতে পারে। তখন পানিতে বসবাসকারী মাছ সহ সকল প্রাণী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে।
এই অবস্থায় বেশিদিন চলতে থাকলে একসময় ওই সকল নদ নদী। আমাদের বুড়িগঙ্গা নদীতে এখন কি মাছ পাওয়া যায় অবশ্যই পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এর অবস্থা অনেকটাই হরি হৃদ মত । শুধু বুড়িগঙ্গা নদী নয় আমাদের দেশের অনেক নদনদীর পানি শিল্প কারখানার সৃষ্ট বজ্র পানির কারণে দূষিত হয়ে পড়ছে, যার কারণে এদের অবস্থা হরি হৃদ এর মত হয়ে যেতে পারে। এভাবে আমাদের এখন সতর্ক না হলে এটি ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বুড়িগঙ্গা এবং অন্যান্য নদীর পানি দূষণমুক্ত করার জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা করে কাজ শুরু হয়েছে বলে আমরা জানি। পানিতে থাকা ধাতব পদার্থ যা আমাদের জন্য ক্ষতিকর যথা-
- পারদ: মস্তিষ্ক বিকল হওয়া, ত্বকের ক্যান্সার, বিকলাঙ্গ হওয়া।
- সিসা: ব্রিটিশ না বোধ বা ছিটখিটে মেজাজ, শরীরে জ্বালাপোড়া, রক্তশূন্যতা, কিডনি বিকল হওয়া, পরিমাণে খুব বেশি হলে মস্তিষ্ক বিকেল হওয়া।
- আর্সেনিক: আর্সেনিক এবং ফুসফুসের ক্যান্সার ও পাকস্থলী রোগ। ব্যবহার করা অজৈব সার দিয়ে পানি দূষিত হলেও মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়
পানি দূষণ প্রতিরোধে কৌশল এবং নাগরিকের দায়িত্ব
পানি কিভাবে দূষণ হয় আমরা মোটামুটি সেটা জেনেছি বা জানি। পানি দূষণ প্রতিরোধ
করতে হলে দূষণের কারণ গুলো জেনে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাটাই হবে দূষণ
প্রতিরোধের বড় কৌশল। পানি দূষণ প্রতিরোধ করতে কি কি কৌশল অবলম্বন করা যায় তা
আমাদের জানা দরকার যথা-
জলভূমি রক্ষা: আজকাল আমাদের দেশে জলভূমি ভরাট করে ঘরবাড়ি, আবাসন এলাকা,
শপিংমল ইত্যাদি তৈরি করা শুরু হয়েছে। জলভূমি একদিকে পানি ধারণ করে যেমন
বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে, অন্যদিকে তেমনি ক্ষতিকর পদার্থ শোষণ করে, ভূগর্ভে এবং
নদীতে বিশুদ্ধ পানি সঞ্চালন করে এবং বন্যপ্রাণীদের সাহায্য করে। বনভূমিও কিন্তু
ভূগর্ভে পানি সঞ্চালনের সাহায্য করে এবং একই সাথে বন্যপ্রাণীদের আশ্রয়স্থল
হিসেবে কাজ করে।
বৃষ্টির পানি নিয়ন্ত্রণ: শহরাঞ্চলে পানি দূষণের একটি বড় কারণ
বৃষ্টির পানির প্রবাহ। শহর অঞ্চলের রাস্তাঘাট সহ বেশিরভাগ এলাকা পাকা হওয়া
কারণেই বৃষ্টির পানি এখান থেকে এর ভেতর দিয়ে ভূগর্ভে যেতে পারে না। ফলে বৃষ্টির
পানি যাবতীয় ময়লা আবর্জনা আর অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ নিয়ে নর্দমা আর নালা
দিয়ে নদী, জলাশয় গিয়ে সেখানকার পানিকে দূষিত করে। কিভাবে এটাকে বন্ধ করা যায়
এ ব্যাপারে বাসার ছাদে বৃষ্টির পানি কি সংগ্রহ করা সম্ভব অবশ্যই এটি সম্ভব এবং
খুব সহজেই তা করা যায়। এভাবে সংগ্রহ করা পানি আমরা বাগান বা ফুলের টবে
ব্যবহার করতে পারি, এমনকি কাপড়চোপড় ধোয়া ও পায়খানা শৌচক কাজে ব্যবহার করতে
পারি। এতে একদিকে যেমন পানি দূষণ বন্ধ হবে অন্যদিকে তেমন পানি সরবরাহের উপর চাপ
কম পড়বে। ঢাকা শহরে গ্রীষ্মকালে অনেক এলাকাতে পানির প্রচন্ড অভাব থাকে। এমনও
দেখা গেছে যে কোন কোন এলাকায় তিন-চার দিন একটা না কোন পানি পাওয়া যায় না। এরকম
অবস্থায় বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করলে পুরো পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায়
সেটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: আমরা সকলেই জানি পানি দূষণের একটি বড় অংশ আসে ক্ষতিকর
বর্জ্যগুলো থেকে যা আমাদের বাসা বাড়ি থেকে এ সকল বর্জ্য তৈরি হয়। আমরা এরোসল,
পেইন্ট, পরিষ্কারক, কীটনাশক নানারকম ক্ষতিকারক পদার্থ ব্যবহার করি এবং ব্যবহারের
পর সেগুলো খালি কৌটা যেখানে সেখানে ফেলে দেই বা রেখে দেই, যেগুলো এক পর্যায়ে এসে
পানি দূষণ করে। এগুলো এভাবে না ফেলে রেখে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলি, তাহলে কিন্তু
পানি দূষণ অনেক কমে যাবে। এসব পদ্ধতিতে দূষণ কমানোর জন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর কোন
বিকল্প নেই। এজন্য রেডিও টেলিভিশনে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান আর সতর্কবার্তা প্রচার
করা যেতে পারে। এমনকি স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা পানির প্রয়োজনীয়তা, অপ্রতুলতা এবং
দূষণ প্রতিরোধ বিষয়ে পোস্টার তৈরি করে মানুষকে সচেতন করতে পারে। ইউরোপ আমেরিকার
মতো উন্নত দেশেও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি ভাবে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া
হয়।
শিল্প কারখানার দ্বারা পানি দূষণ প্রতিরোধ: শিল্প কারখানার সৃষ্ট বর্জ্য
পানি নদীর পানি দূষণের প্রধান একটি কারণ। এই দূষণ প্রতিরোধের সবচাইতে ভালো উপায়
হচ্ছে, সৃষ্ট বজ্রপানি পরিশোধন করে তারপর নদীতে ফেলা। এই পরিশোধন কাজের জন্য
দরকার বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা বা ইটিপি। ইটিপি কিভাবে তৈরি করা হবে, সেটা
নির্ভর করে বর্জ্য পানিতে কি ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ আছে তার ওপর। যেহেতু একেক
ধরনের শিল্প কারখানা থেকে এক এক ধরনের বর্জ্য পানি বের হয় তাই একটি সাধারন ইটিপি
দিয়ে সব কারখানার বর্জ্য পানি পরিশোধন করা সম্ভব না। তবে একই ধরনের শিল্প
কারখানা দিয়ে একটি শিল্প অঞ্চল গড়ে তুলে সব কারখানার বর্জ্য পানি একত্র করে
একটি বড় ইটিপিতে পরিশোধ করা যেতে পারে।
কৃষি জমি থেকে মাটির খয়জনিত দূষণ প্রতিরোধ: একটি জমিতে বছরের পর বছর ফসল
চাষ করলে ধীরে ধীরে তার উর্বরতা নষ্ট হয়। আর উর্বরতা নষ্ট হলে মাটির ক্ষয় অনেক
বেড়ে যায়। আমরা যদি জৈব সার ব্যবহার করে মাটির উর্বরতা বাড়াই, তাহলে সেটি
মাটির ক্ষয়রোধ করতে সাহায্য করে। মাটিতে জৈব সার থেকে আসা জৈব পদার্থ বেশি থাকে
বলে সেটি বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। ফলে, বৃষ্টি হলে খুব সহজেই সেটি
প্রবাহিত হয়ে যায় না। এতে করে মাটির কোন ছাড়াও অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ যেমন
কীটনাশক, নাইট্রোজেন ও ফসফরাস ইত্যাদি দ্বারা দূষণও কমে যায়। আবাদি জমির চারপাশে
পুকুর খনন করেও পানি দূষণ প্রতিরোধ করা যায়।
আমাদের সকলের পচেষ্টায় এই পানি দূষণ রক্ষা করতে পারে। যে সকল কারণে পানি দূষণ হতে পারে সে সকল কর্মকান্ড থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং গণসচেতনতা তৈরি করে পানি দূষণ বন্ধ করা সম্ভব।
পানি প্রবাহের সর্বজনীনতা এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম নীতি
পৃথিবীর সব সাগর মহাসাগর একটি সাথে আরেকটি সংযোগ রয়েছে। আমাদের সাগর-মহাসাগর বা সমুদ্র সবগুলো একটি সাথে আরেকটি সংযুক্ত। আবার পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে সৃষ্ট নদী এক সময়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। অর্থাৎ একটি নদী বা সাগর যেখানেই থাকুক না কেন যে দেশেই এর উৎপত্তি হোক না কেন বা যেখানে দিয়ে এটি প্রবাহিত হোক না কেন, আসলে সেগুলো সারা পৃথিবীর সম্পদ। যার অর্থ পানি সম্পদ অবশ্যই একটি সর্বজনীয় বিষয়।
আরো পড়ুন: প্রতিবন্ধী শিশু কাকে বলে- What is a disabled child?
এটি কোন জাতিগোষ্ঠী, দেশ বা মহাদেশের সম্পদ নয়, এটি সবার সম্পদ। বিভিন্ন দেশের
মাঝে সৃষ্ট রাজনৈতিক রেষারেষি উন্নয়ন সহযোগিতা, স্বার্থপর আচরণ এবং অসহায়ংসিত
মনোভাব এর কারণে পানি সম্পদের এই সর্বজনীনতা অনেক সময়ে মানা হচ্ছে না। তবে
জাতিসংঘ ১৯৯৭ সালে বিভিন্ন দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদ নদী গুলোর ক্ষেত্রে
পানির বন্টন নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমঝোতা চুক্তি তৈরি করে, যদিও চুক্তিটি এখন
পর্যন্ত খুব একটা কার্যকর হয়নি। এছাড়া পানি সম্পদ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে রহিত পদক্ষেপগুলো যথা-
রামসার কনভেনশন: ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে ইরানের রামসারে
ইউনেস্কোর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নেওয়া জলভূমি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো
হচ্ছে রামসার কনভেনশন। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে এই সমঝোতা চুক্তিতে সম্মতি জ্ঞাপন করে
স্বাক্ষর করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮২ ও ১৯৮৮ সালে রামসার কনভেনশন সংশোধন এবং
পরিমার্জন করা হয়।
আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশন: আন্তর্জাতিক আইন সমিতি ১৯৬৬ সালে হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত তাদের ৫২ তম সম্মেলনে আন্তর্জাতিক নদী গুলো পানির ব্যবহার সম্পর্কে একটি কমিটি রিপোর্ট গ্রহণ করে। এটি হেলসিংকি নিয়ম নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আইন কমিশন আন্তর্জাতিক পানির ব্যবহারের জন্য একটি চুক্তি তৈরি করে, যা ১৯৯৭ সালের ২১শে মে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় কনভেনশন হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
উপসংহার
উপরোক্ত বিষয় হতে আমরা জানলাম পরিবেশ সংরক্ষণে পানির ভূমিকা এবং পানি দূষণের
কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়াও আমাদের পানির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। পানি
প্রকৃতির এমন একটি দান প্রায় সব জীবের জন্য অপরিহার্য। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই
মানুষ খাওয়া গোসল রান্না সহ অন্যান্য সকল কাজে পানি ব্যবহার করে আসছে। মানুষের
পাঁচটি মৌলিক অধিকার হলো খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা এবং চিকিৎসা। এর
প্রত্যেকটি পানির উপর নির্ভরশীল তাই পানি হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। আর
যেহেতু এই প্রাকৃতিক সম্পদ কোন দেশ বা জাতি এটি সৃষ্টি করেনি তাই পানির প্রতিটি
ফোটার ওপর পৃথিবীর সব মানুষের অধিকার রয়েছে। কাজেই পানির সুষ্ঠু ব্যবহার
এবং পানি দূষণ হতে নিজেদেরকে বিরত রাখতে হবে
No comments:
Post a Comment